সুন্দরপুর জমিদার বাড়ি, মহেশপুর। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার এস.বি.কে ইউনিয়নের অন্তর্গত সুন্দরপুর। একটি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কপোতাক্ষ নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত প্রাকৃতিক শোভা ছায়া ঘেরা সুনিবিড় পরিবেশ এবং চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্য গ্রামকে খ্যাতিমান করে। রেখেছে এতদঞ্চলে। খালিশপুর থেকে একটি পাকা রাস্তা কিছুদূর দক্ষিণে যেয়ে পূর্বদিকে বাক ঘুরে সুন্দরপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে চৌধুরী বাড়ি হয়ে পূর্বদিকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরে অগ্রসর হলে সহজেই পৌছানো যায় চৌধুরী বাড়ি। স্থানীয় মানুষের নিকট বাড়িটি জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত। চৌধুরী বাড়ির রূপ যৌবন এখন আর নেই। আছে শুধু বাধ্যকের ছাপ। জমিদার গেছে জমিদারিও গেছে। আছে শুধু জরাজীর্ণ এবং প্রায় ভঙ্গুর কয়েকটি ইমারত। শোনা যায় আদিতে মূল বাড়ির আয়তন ছিল ৫০ একর জমি জুড়ে বর্তমানে শরিক বৃদ্ধির ফলে বহু অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। ফলে মূল ভবনগুলো স্মৃতিময় ঐতিহাসিক নিদর্শন মাত্র এবং যথারীতি অবহেলিত। স্থানীয় লোকে বলে চৌধুরী বংশের প্রভাবে গ্রামের নামকরণ হয়েছে সুন্দরপুর। S.B.K. তিনটি গ্রামের প্রথম ইংরেজি অক্ষর নিয়ে এই নাম। S= Sundarpur. B= Bazrapur, K=Khalishpur. সুন্দরপুর, বজরাপুর, খালিশপুর তিন গ্রাম পাশাপাশি অবস্থিত এবং মোঘল আমল থেকে বেশ নামকরা জনপদ, ব্রিটিশ শাসনামলে এই তিন গ্রামের নাম ও গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায় তখন জমিদার পরিবার হিসেবে এই বংশের প্রভাব ও প্রতিপ্রত্তি ছিল তুঙ্গে।
সুন্দরপুরের চৌধুরী তালুকদার বংশ স্থানীয়ভাবে জমিদার বংশ নামে পরিচিত। এই বংশের সামাজিক পদবি ‘চৌধুরী’। ‘চৌধুরী’ শব্দের অর্থ সর্বকর্মে সুদক্ষ। মধ্যযুগে সমাজ-গঠনে সামাজিক শাসন শৃঙ্খলা সংরক্ষণে যারা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তারা জাতিধর্ম-নির্বিশেষে ‘চৌধুরী’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। সুলতানি ও মোঘল আমলে চৌধুরী ছিলেন প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী। তখন চৌধুরী পদবি ছিল কখনো মনোনয়নমূলক এবং কখনো ভূ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী । ব্রিটিশ আমলে ‘রায় চৌধুরী’ উপাধি দেয়া হতো জমিদারদের ও তাদের অধস্তন তালুকদারদের।
ভূ-সম্পত্তির স্বত্বশ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী সুন্দরপুরের চৌধুরী বংশ প্রথমে পত্তনিদার, পরে অধিক তালুক ক্রয় করে হয়ে যায় তালুকদার। তালুকের স্বত্বধিকারীতে বলা হতো তালুকদার। এ ক্ষেত্রে মূল জমিদার খাজনা কমায়ে নগদ সেলামি বেশি আদায় করতো তালুকদারের কাছ থেকে। চিরস্থায়ী কন্দোবস্তের সময় এই প্রথা চালু ছিল বাংলার সর্বত্র। তালুকদারেরা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন জমিদার নামে এবং প্রজারা দেরকে জমিদার নামে সম্বোধন করতো। সে সুবাদে সুন্দরপুরের চৌধুরী বংশ জমিদার নামে খ্যাত।
এখানে উল্লেখ্য যে, জমিদার ফারসি শব্দ, যার অর্থ ভূ-স্বামী। একটি পরগণার অধিকারীকে জমিদার বলা হতো। তারা বড় জমিদার নামে পরিচিত ছিলেন। জমিদারেরা সাধারণত রাজা, বাদশা, নবাব কিংবা ব্রিটিশদের অনুগ্রহে মনোনীত হতো। এরা মূলত রাজস্ব আদায়ের জন্য ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি। পরে লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় (১৭৮৬-১৭৯৩ খ্রি.) ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এরা প্রকৃত জমিদার শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। ভূ-সম্পত্তির স্বত্বশ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী জমিদার ছিলেন প্রথম শ্রেণির স্বত্বাধিকারী। বিশাল পরগণার রাজস্ব যথাযথভাবে রায়তদের নিকট থেকে আদায় করা জমিদারদের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। সে জন্য তারা জমিদারির বিভিন্ন অংশ নিদিষ্ট বার্ষিক রাজস্বের বিনিময়ে বন্দোবস্ত দিত, এগুলোকে তালুক এবং বন্দোবস্ত গ্রহণকারীকে বলা হতো তালুকদার। তালুকদার রায়তদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করে জমিদারকে বার্ষিক রাজস্ব প্রদান করতো এবং এর ফলে তালুকদারি রক্ষা পেত। তবে কারা জমিদার অথবা তালুকদার সে বিষয় নিয়ে প্রজারা মাথা ঘামাতো না। যাকে প্রজারা খাজনা দিত তাকে জমিদার বলে সম্বোধন করতো। প্রজারা সে সুবাদে সুন্দরপুরের চৌধুরী বংশ তালুকদার হয়েও জমিদার বলে সুবিদিত ছিল এতদঞ্চলে।
বজরাপুর পত্তনি তালুকদার বংশ
বজরাপুরের পত্তনি তালুকদার বংশ। বজরাপুর মহেশপুর উপজেলার এস.বি.কে ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি প্রচীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম। খালিশপুর সংলগ্ন পূর্ব পাশে অবস্থিত। শোনা যায় এই গ্রামে ছিল ১৩ টি পত্তনি তালুকদার পরিবার। স্থানীয়ভাবে তারা পরিচিত ছিলেন জমিদার হিসাবে। এসব তালুকদার পরিবার ছিলেন নলডাঙ্গা রাজ এস্টেটের অধীন বলে জানা যায়। সরেজমিনে গিয়ে প্রাচীন বাড়ির ধ্বংস স্তুপ দেখতে পেলাম (১৩-০৬-২০১০)। তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তুপ ও ক্ষয়িষ্ণুরূপ দেখে তাদের বিগত দিনের সম্মান ও প্রতিপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্রিটিশ আমলে বজরাপুর ইউনিয়ন ছিল।
পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-১৯৭১) বজরাপুরের সাথে খালিশপুর ও সুন্দরপুর গ্রামের নাম সংযুক্ত করে ইউনিয়নের নাম রাখা হয় এসবিকে ইউনিয়ন। বজরাপুরের তারিণী দত্ত ছিলেন একজন পত্তনি তালুকদার। তিনি ছিলেন একজন বৈষয়িক ও করিৎকর্মা লোক। তিনি পেশাগত ভাবে ছিলেন ব্যাবসায়ী। দত্ত হিন্দুদের একটি বংশ পদবি। পেশাগত কাজ ব্যাবসা করা। তারিণী দত্ত ব্যবসার সাথে সাথে কয়েকটি মৌজার তালুকদারি কিনে হয়ে ওঠেন অধিক সম্পদশালী ও প্রতিপত্তি শালী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে বজরাপুরের বাড়ি বিনিময় করে তারিণী দত্তের বংশধরেরা চলে যান পশ্চিমবঙ্গে (ভারতে)।(সাক্ষাৎকারঃ তপনকুমার গাঙ্গুলী, মহেশপুর, বয়স ৯২, তাং ২২-৬-১৯৮৫)।
খালিশপুর
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপলাের এসবিকে (সুন্দরপুর, বজরাপুর, খালিশপুর) ইউনিয়নের অন্তর্গত খালিশপুর একটি প্রাচীন স্থান। কালীগঞ্জ হতে পাকা রাস্তা কোটচাঁদপুর, খালিশপুর, ফতেপুর, দত্তনগর জীবননগর, দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা। গিয়ে মিশেছে। বাসযােগে এ রাস্তা ধরে ২৮ কিমি. পশ্চিমে অগ্রসর হলে খালিশপুর পৌছানাে যায় সহজে। খালিশপুর হতে পাকা রাস্তা মহেশপুর চলে গেছে। খালিশপুরের পূর্বদিকে বজরাপুর ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সুন্দরপুর দু’টি সমৃদ্ধ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। বজরাপুরে বেশ কয়েকঘর হিন্দু পত্তনি জমিদারের বসতি ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মামা বাড়ি ছিল বজরাপুর। শােনা যায় সাড়ম্বরে ধূমধামের সাথে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হতাে বজরাপুর। তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) প্রতি বছর মামা বাড়ির কালীপুজায় যােগদান করতেন তার কর্মজীবনে। সুন্দরপুরের চৌধুরী জমিদার বংশ মুসলিম পরিবার হিসেবে বেশ নামকরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পেলাম বহু পাকা ঘর বাড়ি ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় দাঁড়িয়ে এ বংশের সাক্ষ্য বহন করছে।
খালিশপুরের নামকরণ সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না । শােনা যায় অতীতে খালিশপুর নদী বন্দর হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। কলকাতা হতে নৌকা ভর্তি মালামাল এখানে আনা হতাে। সে মাল খালাশ করা হতাে এখানে। সে হতে এ স্থানের নামকরণ হয়েছে খালিশপুর । এস.বি.কে ইউনিয়ন পরিষদ অফিস খালিশপুরে অবস্থিত। খালিশপুর হতে একটি ইট বিছানাে রাস্তা বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে খাের্দ খালিশপুরের দিকে চলে গেছে। এ গ্রাম (খাের্দ খালিশপুর) বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমানের জন্মগ্রাম ।
কপােতাক্ষ নদের উত্তর তীরে দ্বিতল জীর্ণ নীলকুঠি এখনও ঘােষণা কর, নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী। ভগ্নদশা নীলকুঠি যে কোনাে মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। খালিশপুরে শুক্রবার ও সােমবার সাপ্তাহিক হাট বসে। গরু ছাগলের জমজমাট পশু হাট বসে শুক্রবারে । শাক সবজি ও রবিশস্যের আমদানি হয় প্রচুর এ-হাটে। ট্রাক ভর্তি কাঁচা শাক-সবজি ও কলা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে চালান দেয়া হয়। তবে এ হাটে ধান ক্রয়-বিক্রয় হয় না। শীতকালে প্রচুর খেজুর গুড় কেনাবেচা হয়। খালিশপুর বাজারের সামান্য দক্ষিণে ভালাই শাহ দেওয়ানের পাকা সমাধি বিদ্যমান। তাঁরই নামানুসারে ভালাই গ্রামের নামকরণ হয়েছে বলে অধিকাংশ লােকের ধারণা। খালিশপুর বাজারের মধ্যদিকে পাকা রাস্তা চলে গেছে, সে জন্যেই এ রাস্তার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে বহু পাকা দোকান ঘর গড়ে উঠেছে। খালিশপুর সদরে স্থাপিত হয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কলেজ (স্থাপিত:১৯৯৯সাল), বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান যাদুঘর (স্থাপিত:২০০৭সাল), মাধ্যমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত:১৯৬৩) ও প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত ১৯৭৪)। কলেজটি জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে। ক্ষেত্রানুসন্ধান কালে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ সাহেবদের মনােরঞ্জনের জন্য দুটি পতিতা পল্লি গড়ে উঠেছিল খালিশপুর নীলকুঠির কিছুদূর উত্তরে । লক্ষীবিলাস নামে একটি আধাপাকা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনাে বিদ্যমান। নীলকুঠির দক্ষিণে কপােতাক্ষ নদের মধ্যপর্যন্ত নির্মিত স্নানঘাট ব্যবহারের অনুমতি ছিল পতিতাদের। সে ঘাটে অন্য কেউ গােসল করতে পারতাে না। কিন্তু ইংরেজ ও পতিতারা একত্রে গােসল করতাে বলে শােনা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও পতিতাদের আনাগােনা ছিল এ পতিতা পল্লিতে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান আমলে পতিতাদের উচ্ছেদ করা হয় খালিশপুর থেকে। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন খালিশপুর। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনাজউদ্দিন আহমদ। তৎপর পতিতাদের কার্যক্রম চিরতরের জন্য খালিশপুরে বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকাগামী বাসের কাউন্টার আছে এখানে। ৫৮ ব্যাটালিয়ানের বিজিবি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ উদ্বোধন করা হয় ২০১৪ সালে।
তথ্যসূত্র ঃ ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস পরিক্রমা (দ্বিতীয় খন্ড)
তথ্য সংগ্রহে
মোঃ রাশিদুল ইসলাম
পুরুষ উদ্যোক্তা
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস