বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর রূপান্তর ও নাগরিক সেবার আধুনিকায়নে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” ভিশন একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এই ভিশনের আওতায় ২০১০ সালে চালু হওয়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC)-সমূহ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সরকারি-বেসরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। “UDC কী এবং কেন প্রয়োজনীয়”—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা দেখতে পাই, এটি শুধু একটি সেবা কেন্দ্র নয়; এটি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক পরিবর্তনের বাহক।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC) হলো বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত একটি তথ্য ও সেবাদানকারী কেন্দ্র, যা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়।
এই কেন্দ্রগুলো সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট কক্ষে স্থাপন করা হয় এবং এটি পরিচালনা করেন একজন নারী এবং একজন পুরুষ উদ্যোক্তা। তাদের কাজ হলো অনলাইনে নাগরিক সেবা প্রদান, তথ্য সরবরাহ এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি করা।
UDC-এর প্রতিষ্ঠার পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে:
সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া
তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বজনীন করা
সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
বেকার যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা
নারীর ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করা
ডিজিটাল ডিভাইড দূর করে সামাজিক সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করা
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করে, তখন পরিষ্কারভাবে বলা হয়—দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কাছে প্রযুক্তিনির্ভর সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর দেশের ৪,৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে UDC চালু করা হয়।
এই দিনটিকে সরকার “জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিবস” হিসেবেও ঘোষণা করে।
UDC থেকে নাগরিকরা নিম্নোক্ত সেবাসমূহ পান:
জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিক সনদ
ভূমি খতিয়ান, পর্চা, নামজারি আবেদন
পাসপোর্ট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আবেদন
ট্রেড লাইসেন্স ও বিভিন্ন ফরম পূরণ
বিভিন্ন ভাতা (বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী) আবেদন
অনলাইন ভর্তি ও আবেদন ফরম পূরণ
শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি সংক্রান্ত সহায়তা
কম্পিউটার ও আইটি প্রশিক্ষণ
অনলাইন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট
টেলিমেডিসিন
স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক তথ্য
কৃষি তথ্য ও পরামর্শ
ডিজিটাল কৃষি সেবা
ফসলের বাজার দর
কৃষি ঋণ ও অনুদান বিষয়ক তথ্য
স্থানীয় পণ্যের অনলাইন বিপণন
ডিজিটাল মার্কেটিং প্রশিক্ষণ
ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর ব্যবস্থা
বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা
অনলাইন বিল পরিশোধ (বিদ্যুৎ, গ্যাস)
ব্যাংকিং তথ্য ও সহায়তা
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এর বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই গ্রামে বাস করে। তথ্য ও প্রযুক্তির সুবিধা আগে পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক ছিল। একারণে গ্রামের মানুষ সরকারি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতি, হয়রানি ও যাতায়াতে অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। এই প্রেক্ষাপটে UDC-এর প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জনগণ সরাসরি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে সেবা নিতে পারে। এতে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের প্রয়োজন কমে যায়।
আগে যে কাজের জন্য ইউনিয়ন থেকে উপজেলা বা জেলা সদরে যেতে হতো, তা এখন নিজের ইউনিয়নে বসেই করা যায়। এতে সময় ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় হয়।
UDC-তে নারী উদ্যোক্তা থাকা বাধ্যতামূলক। এতে নারীরা প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
UDC উদ্যোক্তারা নিজেরা যেমন উপার্জন করতে পারছেন, তেমনি স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলার কাজও করছেন।
সব সেবাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্পাদিত হয়। ফলে অনিয়ম ধরা পড়ে এবং প্রশাসনের ওপর আস্থা বাড়ে।
UDC মানুষকে শুধু সেবা দিচ্ছে না, বরং প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা গড়ে তুলছে—যা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের ভিত্তি।
প্রতিটি UDC পরিচালনার জন্য একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা স্বনির্ভরভাবে কাজ করেন এবং তাদের আয়ের উৎস মূলত সেবার বিনিময়ে প্রাপ্ত ফি। সরকার তাদের প্রশিক্ষণ ও নির্দিষ্ট পরিমাণ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে থাকে।
তথ্যসেবা প্রদান
সেবাপ্রার্থীদের সহায়তা
প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি
সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন UDC থেকে সেবা নিচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এই মডেলকে প্রশংসা করেছে। বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের এই উদ্ভাবন অনুকরণ করেছে।
বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় UDC গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
অনলাইন শিক্ষা সহায়তা
টিকাদান নিবন্ধন
স্বাস্থ্য তথ্য সরবরাহ
ত্রাণ তালিকা তৈরি
উদ্যোক্তাদের নির্দিষ্ট সম্মানী না থাকা
পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট সংযোগের অভাব
স্থান সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা
কিছু ইউনিয়নে নারী উদ্যোক্তার নিরাপত্তা ও সামাজিক বাধা
জনগণের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অজ্ঞতা
গ্রামে গ্রামে প্রযুক্তির বিস্তার
ই-কমার্স ও ফ্রিল্যান্সিং সম্প্রসারণ
ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা
কৃষি ও স্বাস্থ্যখাতে তথ্যভিত্তিক সহায়তা
উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান
UDC-এর কার্যক্রম আরও কার্যকর করতে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরি:
উদ্যোক্তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান
প্রতি বছর রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ আয়োজন
সুবিন্যস্ত মনিটরিং ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগে প্রবেশের এক অনন্য উদাহরণ। এটি শুধু প্রযুক্তির সেবা নয়, বরং একটি সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা। একজন নারী যখন নিজের হাতেই অনলাইন ফরম পূরণ করতে শেখেন বা একজন কৃষক যখন মোবাইলে নিজের জমির খতিয়ান ডাউনলোড করতে পারেন—তখন বোঝা যায়, UDC কেবল প্রযুক্তির নয়, মানবিক উন্নয়নেরও প্রতীক।
আমরা যদি UDC-কে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, নীতি সহায়তা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করি—তাহলে এটি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে পরিণত হবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস